কৃষি জমিতে জীবন ফেরাচ্ছে বাগেরহাটের সুমি হাওলাদার

Written by
বিলাল হোসেন
Published on
May 18, 2025

জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারনে বাংলাদেশের কৃষির উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। আবহাওয়ার ধরনে পরিবর্তন প্রায়শই খরা, তাপপ্রবাহ এবং ঘন ঘন বন্যার দেখা দিচ্ছে। এর প্রভাবে পানির সংকট, জমি এবং ফসলের উৎপাদনক্ষমতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি খরচও বাড়ছে কৃষি পণ্য উৎপাদনে। ফলে কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করছে। অন্যদিকে উৎপাদনের তুলনায় খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগ তুলতে কৃষি জমিতে মাত্রারিক্ত রাসায়নিক সার ও কিটনাশক ব্যবহার করছে কৃষকরা। যার মারাত্মক প্রভাব পরছে মাটির উপর, মাত্রারিক্ত রাসায়নিক সার ও কিটনাশকের ব্যবহার মাটির উর্বরতা নষ্ট করে দিচ্ছে। যার ভবিষ্যতে মারাত্মক ঝুকির দিকে নিয়ে যাচ্ছে দেশের কৃষি খাতকে। এমন পরিস্থিতিতে মাটির উর্বরতা ফেরাতে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। 

এরই অংশ হিসাবে দেশের লবন পানি অঞ্চল হিসাবে খ্যাত উপকেূলীয় জেলা বাগেরহাটে ভার্মি কম্পোস্ট বা কেচোঁ সারে ভাগ্যো ফিরেছে অনেক উদ্যোক্তার। তাদেরই একজন বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার বাহিরদিয়া ইউনিয়নের মানসা গ্রামের বাসিন্দা সুমি হাওলাদার। স্বামী পরিত্যাক্তা ৩৫ বছর বয়েসী এই নারী তার দুই ছেলে সন্তান ছোট এক খন্ড জমিতে বসবাস করেন। স্বামী চার বছর আগে আরকেটি বিয়ে করে চলে যাওয়ার পর একটা সময় দুই সন্তান নিয়ে খেযে না খেয়ে দিনপার করতেন তিনি। একটা সময় পরিবারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে ভার্মি কমপোস্ট বা কেঁচো সার উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। 

সুমী হাওলাদার জানান, ৪ বছর আগে স্বামী চলে যাওয়ার পর ফকিরহাট কৃষি অফিসের সহযোগিতায় বসত ভিটায় আঙ্গিনায় ভার্মি কম্পোস্ট এর দুটি রিং প্লান্ট তৈরী করি। প্রথম দিকে বিক্রি না হওয়ায় বিপাকে পড়ে যাই। একটা সময় বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সার বিক্রির বিজ্ঞাপন দিতে থাকি। এতে ভালো সাড়া পাই। বিভিন্ন এনজিও, সৌখিন বাগানি, স্থানীয় কৃষকসহ বিভিন্ন লোক এসে সার কিনতে থাকে। প্রথমদিকে প্রতি কেজি সার ১২ টাকা করে বিক্রি করলেও বর্তমানে প্রতি কেজি সার ১৫ টাকায় বিক্রি করি। এতে মাসে প্রায় ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা আয় হয় আমার। 

কি ভাবে সার তৈরী করেন এমন প্রশ্নের জবাবে সুমি জানান, প্রথমে গরুর খামাম বা আশপাশের বিভিন্ন এলাকার গরুর গোয়াল থেকে গোবর সংগ্রহ করি এর সাথে পঁচা ঘাস প্লান্টে দিয়ে প্লান্টের মধ্যে ২শ থেকে ৩শ কেঁচো ছেড়ে দিই। ১৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে সার উৎপাদন শুরু হয়ে যায়। মূলক এই গোবর ও পঁচা ঘাস খেয়ে কোঁচো যেটি ত্যাগ করে, সেটাকে হাতে ঘুড়ানো মেশিনে ছেকে সার তৈরী করা হয়। 

সুমি আরও জানান, বর্তমানে সার তৈরী করার জন্য তার ৫০টি রিং প্লান্ট রয়েছে। তার উৎপাদিত সার কৃষকরা ধানসহ বিভিন্ন রকমের সবজিতে ব্যবহার করে সফলতা মুখ দেখেছেন। আগামী আরও ৫০টি প্লান্ট তৈরীর ইচ্ছার কথা জানান সুমি। 

সুমির বড় ছেলে সামিউল আলিম স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেনীর শিক্ষার্থী, পড়াশুনার ফাকে সেও তার মাকে সার তৈরীতে সহযোগী করে। সামিউল জানায়, তাদের দেখাদেখি তাদের অনেক প্রতিবেশি কোঁচো সার তৈরীর প্লান্ট তৈরী করেছে। 

সুমির প্রতিবেশি প্রদিপ পাল জানান, সুমির দেখা দেখি আমি আমার বাড়ীতে দুটি রিং প্লান্ট তৈরী করেছি। আমার প্লান্টে উৎপাদিত সার আমার জমিতে ব্যবহার করি। আমার নিজের গরু রয়েছে তাই সহজে সার তৈরী করতে পারি। আমার সবজি ও ধান ক্ষেত্রে এ সার ব্যবহার করছি। এছাড়া এ বছর আমার পন বরজে ব্যবহার করে ভালো ফলাফল পেয়েছি। আমাদের গ্রামের অনেকেই এখন এই কোঁচো সার তাদের পান বরজে ব্যবহার করে ভালো ফলাফল পাচ্ছে। 

বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জমির উর্বরতা বাড়াতে ব্যবহার করা হয় কেঁচো সার বা ভার্মি কম্পোস্ট। এটি মূলত বাসী গোবর বা ঘাষ খেয়ে কেঁচো মল ত্যাগ করে এবং এর সাথে কেঁচোর দেহ থেকে রাসায়নিক পদার্থ বের হয়ে যে সার তৈরি হয় তাঁকে কেঁচো কম্পোস্ট বা ভার্মি কম্পোস্ট বলা হয়। এটি সহজ একটি পদ্ধতি ১ মাসের বাসী গোবর ব্যবহার করে তৈরী করা হয়। এ সার সব ধরণের ফসলের ক্ষেতে ব্যবহার করা যায়। ভার্মি কম্পোষ্ট বা কেঁচোসারে মাটির পানি ধারণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং বায়ু চলাচল বৃদ্ধি পায়। যার ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। কেঁচো সার ব্যবহার করলে ফসলের উৎপাদন ও গুণাগুণ কয়েক গুন বৃদ্ধি পায় এবং চাষের খরচ কম হয়। উৎপাদিত ফসলের বর্ণ, স্বাদ, গন্ধ হয় আকর্ষণীয়। 

প্রধান উপকরণ

কেঁচো ২শ থেকে ৩শ টি। মাটির তৈরি নালা বা চারি অথবা ইট দিয়ে নির্মিত চৌবাচ্চা এবং ১ মাসের বাসী গোবর।

সার তৈরি করার পদ্ধতি

২ মিটার লম্বা, ১ মিটার চওড়া ও ১ মিটার গভীরতা বিশিষ্ট ইট দিয়ে চৌবাচ্চা তৈরি করতে হবে। চৌবাচ্চার উপর টিনের/খড়ের চালা দিতে হবে। গর্তের মধ্যে বাসী পচা গোবর ঢেলে ভরে দিতে হবে। অতঃপর ২০০ থেকে ৩০০ কেঁচো ছেড়ে দিতে হবে। এ কেঁচোগুলো গোবর খেয়ে সার মল ত্যাগ করবে। এই মলই কেঁচো সার। কেচোর সংখ্যার উপর ভিত্তি করে সার তৈরীর সময় নির্ভর করে। সংখ্যা বেশী হলে দ্রুত সার তৈরি হবে। কেঁচো সার দেখতে চায়ের গুড়ার মত। সার তৈরি হওয়ার পর চৌবাচ্চা হতে সতর্কতার সাথে কম্পোস্ট তুলে চালুনি মেশিন বা হাতের চালুনি দিয়ে চালতে হবে। চালুনীর সময় সাবধান থাকতে হবে যেন শিশু কেঁচো মারা না যায়। শিশু কেঁচোগুলো পুনরায় গর্তে রক্ষিত বাসী গোবরের মধ্যে কম্পোস্ট তৈরির জন্য ছেড়ে দিতে হবে। পিপঁড়া, উইপোকা, তেলাপোকা, মুরগী, ইঁদুর, পানি ও পোকার কামড় থেকে কেঁচোগুলোকে সাবধানে রাখতে হবে। প্রয়োজনে চৌবাচ্চার উপর মশারী ব্যবহার করতে হবে।

কোথায় ব্যবহার করা যায় 

সকল প্রকারের শাক সবজি ক্ষেতে ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করে শাক সবজির ফলন বাড়ানো যায়। ধান, গম, পাটসহ বিভিন্ন ফলবাগানে এই সার ব্যবহার করে ভাল ফলন পাওয়া যায়। এই সার ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি বাড়ে মাটিতে বায়ুচলাচল বৃদ্ধি পায়। মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ে, মাটির বিষাক্ততা দূরীভূত হয়। মাটির অনুজৈবিক কার্যাবলী বৃদ্ধি পায় ফলে মাটি হতে গাছের পুষ্টি পরিশোধন ক্ষমতা বেড়ে যায়। এই সার ব্যবহার করলে রাসায়নিক সার মাত্রার ১/২ অংশ ব্যবহার করলেই চলে। এই সার পুকুরে ব্যবহার করে ফাইটোপ্লাংকটন উৎপাদন ত্বরান্বিত করে মাছের উৎপাদন বাড়ানো যায়।

বাগেরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শঙ্কর কুমার মজুমদার জানান, কেঁচো সার ব্যবহার করলে ফসলের উৎপাদন ও গুণাগুণ বৃদ্ধি পায় এবং চাষে খরচ কম হয়। উৎপাদিত ফসলের বর্ণ, স্বাদ, গন্ধ হয় আকর্ষণীয়। ভার্মি কম্পোষ্ট বা কেঁচো সারে মাটির পানি ধারণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং বায়ু চলাচল বৃদ্ধি পায়। ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। আমরা কৃষি বিভাগ বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের ভার্মি কম্পোষ্ট বা কেঁচো সার তৈরীর প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছি। এতে সবচেয়ে বেশি আগ্রহি হচ্ছে নারীরা। নিজ বাড়ীতে ভার্মি কম্পোষ্ট বা কেঁচো সার তৈরীর রিং প্লান্ট বসিয়ে সহজে সার উৎপাদন করছেন তারা। এতে নারীরা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি তাদের সংসারে আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।  

তিনি আরও জানান, এ বছর বাগেরহাটে ৪ হাজার ৫৬০ মেট্রিক টন কম্পোষ্ট বা কেঁচো সার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।  যার মধ্যে ২৫৬ মেট্রিক টন ইতি মধ্যেই উৎপাদন করা হয়েছে।

 

মামুন আহমেদ

বাগেরহাট

18.12.2024

Join Our Coastal Community

Be part of the solution to climate change. Your voice matters in our mission. Get monthly update from us straight to your mailbox.

By clicking Sign Up you're confirming that you agree with our Terms and Conditions.
Thank you! Your submission has been received!
Oops! Something went wrong while submitting the form.