সাতক্ষীরা উপকূলে বিলুপ্তির পথে গবাদি পশু

Written by
এম জুবায়ের মাহমুদ
Published on
May 31, 2025

সুন্দরবন তীরবর্তী সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার একটি ইউনিয়নের নাম বুড়িগোয়ালীনি। গবাদী পশু বি‌শেষত গরু পালন ও দুধ বিক্রিতে সুনাম ছিল ব‌লে অত্র এলাকার নাম হয় বু‌ড়ি‌গোয়ালীনী। ই‌তিহাস ও গ‌বেষণা থে‌কে জানা যায়, বাংলাদেশের ১৯ জেলা নিয়ে গ‌ঠিত উপকূলীয় অঞ্চলের মধ্যে দুধের সহজলভ‌্যতার কার‌নে সাতক্ষীরা প্রচীন কাল থেকে মিষ্টি ও ছানার জন্য বিখ্যাত ছিল। এ অঞ্চলে এত বেশি গরু পালন হ‌তো যে এখান থেকে দুধ নৌকায় করে কলকাতায় নি‌য়ে যাওয়া হ‌তো।

মাত্র দু‌য়েক-এক দশক আ‌গেও এখানকার মানুষের অন‌্যতম প্রধান আ‌য়ের উৎস ছিলো গবা‌ধি পশু পালন। গাভীর দুধ বি‌ক্রি ক‌রেই অ‌নেক প‌রিবা‌রের সংসার চল‌তো। কিন্ত বর্তমা‌নে গবাদী পশু বি‌শেষত গরু পালন প্রায় শুন্যের কোটায় নে‌মে এসেছে।

জলবায়ু প‌রিবর্তনের ফ‌লে ঘনঘন ঘূর্নিঝড়, বন‌্যার কার‌নে লোনা পা‌নি প্রবেশ, ফ‌সলি জ‌মি‌তে লবণাক্ততা বৃ‌দ্ধি পাওয়ায় ফস‌লের প‌রিব‌র্তে ঘে‌র তৈ‌রি ক‌রে মাছ চাষ, লবণাক্ততার জন‌্য চারণভূ‌মি নষ্ট হ‌য়ে যাওয়া ইত‌্যা‌দি কার‌নে এখন আর গবাধি পশু পালন সম্ভব হ‌চ্ছে না।

দুই দশক আ‌গে শ্যামনগরের আটুলিয়া ইউনিয়নের হাবিবুর রহমান দুই লক্ষ টাকা খরছ ক‌রে গরুর খামারের ঘর তৈ‌রি ক‌রে‌ছি‌লো। দুইজন করর্মচারী রেখে খামারে ৩০ টি গরু নিয়ে ব্যাবসা শুরু করে প্রথম ক‌য়েকবছর বছর ভালোভাবে পরিচালনা হলেও ২০০৯ সালে ঘূর্নিঝড় আইলায় লোনা পানি আসার কারনে কিছু গরু মারা যায় এবং শুরু হয় রোগব‌্যধি। অন্য দিকে লোনা পানির কারনে ঘাস ও খড় কমে যাওয়ায় সম্পন্ন বাজারের খাবারের উপর নির্ভর করতে হতো তা‌কে। ফ‌লে আর লা‌ভের মুখ দে‌খেন‌নি তি‌নি। অব‌শে‌ষে গরু পালন ছাড়‌তে বাধ‌্য হ‌লেন।

বু‌ড়ি‌গোয়ালী‌নি ইউনিয়নের নীলডুমুর এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমা‌নের এক দশক আ‌গেও গরু ছিল ১৭ টি। এর ম‌ধ্যে  ৮ টি গাভীর দুধ বিক্রি করে মাসে ইনকাম হ‌তো ৯-১০ হাজার টাকা এবং বছর শেষে কিছু গরু বিক্রি করে ইনকাম করতেন লক্ষ টাকা আর এখন গোয়াল আছে কিন্ত তাতে গরু নেই।

উপজেলার আটুলিয়া ইউনিয়নে বিড়ালক্ষীর বাসিন্দা শওকাত হোসেনের ৯ বছর আগে গরু ছিল ১৪ টি। গাভীর দুধ বি‌ক্রি ক‌রে সচ্ছল জীবন যাপন করতেন তি‌নি। বর্তমা‌নে তার গোয়া‌লে গরু আ‌ছে ২ টি তাও নানান রোগে আক্রান্ত।

একই এলাকার সোনাবান বেগমের একদশক আগেও ছাগল ছি‌লো ৩১ টি। আর এখন তিন‌টি ছাগল পালন কর‌তেও হিম‌শিম খা‌চ্ছে সোনাবান।

শুধু গরু নয়, ছাগল ও ভেড়া পালনও হ্রাস পে‌য়ে‌ছে। এমন‌কি খাল বিলের মাছ তোড়, লাটা,শৌল, ইত্যাদি, পাখি যেমন চিল, সকুন, টিয়া, দোয়েল, সালিকও কমে গে‌ছে। লবণাক্ততা বৃ‌দ্ধি পাওয়ায় তাল, অর্জুন ও শুপারী গাছও উ‌ল্লেখ‌যোগ‌্য হা‌রে হ্রাস পে‌য়েছে।

বেসরকারী উন্নয়ন সংগঠন সিডিওর নিবার্হী পরিচালক গাজী আল ইমরান ব‌লেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফ‌লে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ধান চাষে ব্যহত হয়ে‌ছে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে মানুষ চিংড়ি চাষের উপর নির্ভরশীল হয়ে‌ছে। ফ‌লে গো খাদ্যের চারনভূমির অভাব দেখা দি‌য়ে‌ছে। উচ্চমূ‌ল্যে কুড়ু, ভূশি, খৈল ইত্যাদী ক্রয় ক‌রে গরু পালন করতে পারছে না তারা। বাজারের খাবার দিয়ে গরু পালন করতে গেলে তাদের লাভ হওয়া তো দূরের কথা উল্টে ক্ষ‌তি হচ্ছে।

স্থানীয় গবাদী পশু চিকিৎসক স্বপন কুমার মন্ডল জানান,  আমাদের এলাকায় লবাণাক্ত পানি বৃ‌দ্ধির ফ‌লে চিংড়ি চাষ বেড়ে যাওয়ায় গরুর চারণভূমি কমে গে‌ছে। পাশাপাশি গরুর জন‌্য সুপেয় পানি অথবা মিঠা পানির পুকুর না থাকায়, লবনাক্ত পা‌নি খে‌য়ে গরুর ফুড পয়জনিং হ‌য়ে পেট ফাপা, পাতলা পায়খানার মতো রোগে আক্রন্ত হচ্ছে।

সাতক্ষীরা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকতা মাহবুব হোসেন বলেন ঘন ঘন বন্যার কারনে লবন পানি প্রবেশের ফ‌লে গবা‌ধিপশু পালন সম্ভব হ‌চ্ছে না।

প্রাণ-প্রতিবেশ গবেষক ও বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক) এর পরিচালক পাভেল পার্থ বলেন, ২০০০ সাল থেকে মূলত এ অঞ্চলে গবাদী পশু পালন কমতে শুরু করে এবং সেটি ২০১০ সালে প্রকট আকার ধারন করে। জলবায়ু পরির্বতনের কারনে বছরে ৩/৪ বার ঘূর্নিঝড় হয়ে বেড়িবাঁধ ভাঙ্গে লোকালয়ে লবনাক্ত পানি ঢোকে, আবার অপরিক‌ল্পিত চিংড়ি চাষের কারনে লবনাক্ততা বৃব্দি পাচ্ছে। এছাড়া আগে দেশি ধান ক্ষে‌তে ঝেউলো, চামনা, কেচুরী ঘাষ হতো যা মূলত গো খাদ‌্য। কিন্ত বর্তমান যেটুকু চাষের জমি আছে অধিক লাভের আশায় সেখানে ব্রি ধান ২৮/২৯ চাষ করা হয় এবং আগাছানাশক ব্যাবহার করা হয় যার কারনে গবাদী পশুর খাদ‌্য ঘাস উৎপাদন হয় না।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় সম্প‌র্কে প‌া‌ভেল পার্থ ব‌লেন, এ প‌রি‌স্থি‌তি থেকে বের হয়ে আসতে হলে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ বন্ধ করতে হবে। এলাকার বিভিন্ন স্থানের খালগুলা ইজারা মুক্ত করে সেগুলো খনন করে গভীর ও প্রসস্থ কর‌তে হ‌বে যা‌তে বন‌্যার প্রাণী ফস‌লের মা‌ঠে প্রবেশ করতে না পা‌রে। এই এলাকার প্রচীন আমলের দে‌শীয় গবাদী পশু পালনের জন্য মানুষ কে উদ্ভুব্ধ করতে হবে। এলাকার কৃষক‌দের বিনা সুধে লোন দিয়ে গবাদী পশু পাল‌নে সহ‌যোগীতা কর‌তে হ‌বে। সরকারী উ‌দ্যো‌গে গবা‌দি পশুর খাবার তৈরী ও খামার প‌রিচালনার প্রশিক্ষন দিতে হবে।

Join Our Coastal Community

Be part of the solution to climate change. Your voice matters in our mission. Get monthly update from us straight to your mailbox.

By clicking Sign Up you're confirming that you agree with our Terms and Conditions.
Thank you! Your submission has been received!
Oops! Something went wrong while submitting the form.