জেলে সুনিল সরকারের গল্প

Written by
বিলাল হোসেন
Published on
May 17, 2025

সুনীল সরকার বয়স ৭০ কাছাকাছি। তিন পুরুষ কাটিয়ে দিলেন সুন্দরবনের পেশায় মাছ কাঁকড়া সংগ্রহ করে। পেশা টিকিয়ে রাখতে ১৯৮৮ সাল থেকে দশটি পরিবারের কে সাথে নিয়ে প্রধান জেলে সুনীল সরকার নিজের গ্রাম ছেড়ে ১০৫ কিলোমিটার দূর পাড়ি দিয়ে শ্যামনগর উপজেলা সুন্দরবনের পারে পূর্ব কালিনগর সর্দার বাড়ির ঘাটে মালঞ্চ নদীতে মাছ ধরছে। প্রায় অধিকাংশ  সময় মালঞ্চ নদীতে নৌকায় তাদের জীবন অতিবাহিত করতে হয়।

গল্পের সাদৃশ্য চিত্র- সুনীল সরকার পিতা মৃত ঈশ্বর শৈলেন্দ্র সরকার তার পিতা মৃত্যু অটল বাড়ই গ্রাম মুড়াগাছা তালা, সাতক্ষীরা। এলাকার নদী ও বনজীবী সংস্কৃতি বলতেই কপোতাক্ষ প্রাণকুলে শালিকা নদীর শাখায় তিন গ্রামে প্রায় ২০০ শতাধিক জেলে পরিবার। এই নদীতে মাছ ধরে জীবন জবিকা নির্বাহ করত। 

সুনীল সরকার পেশায় আদি জেলে সময়ের বিবর্তনে পদবী উপর সামাজিক বেড়াজালের চাপ পড়তে বর্তমানে সরকার পদবীতে নতুন প্রজন্ম পরিচিত।

জেলেদের জীবন নির্ভার জলাভূমি নদী খাল ও সুন্দরবনের মাছ কাঁকড়া সংগ্রহ করে। তালা উপজেলার কপোতাক্ষ ও শালিকা নদীর পানি পবাহ মৃতপ্রায়। নদী শাসন ও দখলদারদের কারণে পরিবার অনেকে পেশা পরিবর্তন করলে সুনীলরা আজ বাগদী জেলে হিসেবে পেশা টিকিয়ে রাখতে ১০৫ কিলোমিটার দূরের পথ পাড়ি দিয়ে সুন্দরবনের মাছ সংগ্রহ করে চলছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও স্মৃতি জড়িত কপোতাক্ষ -মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত কপোতাক্ষ নদ এখানকার জমিদার শ্রেণীর মানুষের মাছ সংগ্রহ করে দিতেন এই জেলে পরিবার গুলি। কথোপকথনে সুনীল সরকারের দাদা মৃত অটল বড়াই ও মাছ দিতেন জমিদারদের। সামাজিক বেড়াজালে জেলে পেশা মালু ছাড়া অন্যরা মাছ সংগ্রহ করলে তাদের বাগদী ও সমাজ চুত্য করা হত।

৯০ এর দশকের সময়ে শালিকা নদীতে বছরে উজানের পানি প্রবাহ থাকতো চার মাস। বাকি সময় ভাটার। এ অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত লবণ পানি প্রবেশ করতো। কপোতাক্ষ ও শালিকা শাখায় সারা বছর প্রচুর মাছ ধরতে পারতো স্থানীয় জেলেরা।

পরবর্তী সময়ে মিষ্টি পানি প্রবাহ কমে যাওয়া ও লবণ পানি প্রবাহ কমে যাওয়াই নদী মরে যায়। নদী শাসন ও দখল শুরু হয়। দুর্বিপাক ও মানবতার জীবন যাপন শুরু হয় জেলে পরিবারের সে সময় অনেকেই পেশা পরিবর্তন করলেও সুনীলরা পৈতৃক পেশা ও সাংস্কৃতি আঁকড়ে রেখেছেন।

কথা হয় সুনীল সরকারের কাকা পরিতোষ সরকার (৭৩) এর সাথে তিনি জানান, কপোতাক্ষ এবং শালিকা নদীতে এক সময় বড় বড় জাহাজ চলতো। আমরা বটতলার ঘাট থেকে বিভিন্ন মালামাল নামাতে দেখতাম। এই গ্রামে আমি সবচেয়ে পুরাতন জেলে ছিলাম। আমার তিনটা জাল নৌকা ছিল। আমি কপোতাক্ষ ও শালিকা নদীতে মাছ ধরতাম বিভিন্ন ধরনের মাছ পেতাম।  আস্তে আস্তে নদীর জোয়ারের সাথে ঘোলা পানি, বালিযুক্ত পানির জোয়ার আসা শুরু করে। এভাবে কয়েক বছর যেতে না যেতে নদীর নাব্যতা হারিয়ে ভরাট হয়ে যায়। আমাদের জাল নৌকা আর ওই নদীতে ধরা সম্ভব হতো না। সে কারণেই বাপ দাদার জেলে পেশাকে টিকিয়ে রাখতে। আমরা সাগরে মাছ ধরতে যেতাম। বয়স হয়ে যাওয়াতে আমি মাছ ধরা বাদ দিয়ে। বাড়ির কাজ করি। বাড়িতে পরিবার-পরিজন রেখে সুনীলের সাথে ১০-১২ টা নৌকা মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন নদীতে মাছ ধরে।

কপোতাক্ষ নদীর পাড়ে বটতলার ঘাটে কথা হয় আবুল কাশেম (৭০) সাথে তিনি বলেন, ষাটের দশকে বাধ নির্মাণের পরে শালিকা এবং কপোতক্ষন নদীর মাঝখানে স্লুইসগেট গেট তৈরি করে। কপোতাক্ষ নদী একসময় এপারে দাঁড়িয়ে ওপরের মানুষ ভালোভাবে দেখা যেত না। মালোদের জাল নৌকায় ঢেকে যেতো পুরা নদী। জোয়ারের পানির সাথে ঘোলা পানি আসায় এবং পানির প্রতিবন্ধকতা তৈরি করায় ৯০ সালের দিক থেকে শুরু হয় নদীভরাট। আস্তে আস্তে নদী একেবারেই মরে যায়। এ নদীতে যারা জাল দিয়ে মাছ ধরত। তারা এখন সাগরে অথবা অন্য নদীতে যেয়ে মাছ ধরে। জেলেদের পেশা পরিবর্তন করতে না পেরে পরিবার-পরিজন, ঘরবাড়ি ছেড়ে নদীতে মাছ ধরে জীবন ধারণ করে।

পরিবেশ নিয়ে কাজ করা লিডার্স এর নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার বলেন, নদী ভরাটের কারণে পরিবেশের ব্যাপক সমস্যা দেখা দেয়। নদী ভরাটের ফলে মানুষ তার পেশাকে টিকিয়ে রাখতে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। যাতায়াত এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার খুবই সমস্যা দেখা দিছে। এছাড়া নদীভরাটার কারণে আমাদের সাংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। নদীর স্রোতের গতি প্রবাহ বাধা সৃষ্টি করার কারণে নদী মরে যাচ্ছে।

নদী গবেষক সাতক্ষীরা আদি যমুনা নদী বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী বলেন, সরকারি তথ্য অনুযায়ী সাতক্ষীরা জেলায় ২৫ টির মত নদী আছে যার অধিকাংশ নদীগুলাই ভরাট হয়ে যাওয়ার পথে। আদি যমুনা, কপোতাক্ষ, শালিকা, আইবুড়া নদী, কদমতলা নদী, মরিচ্চাপ নদী, কাক শিয়ালি নদী সহ অনেক নদী দিন দিন নাব্যতা হারাতে বসেছে। নদীর প্রাকৃতিক গতি প্রবাহ বন্ধের মূল কারণ হলো সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ না করে বাধ নির্মাণ করা। উপরের পানি নিচে আসার সুযোগ তৈরি না করে দেওয়া। নদীর সীমানা নির্ধারণের জটিলতা থাকায় নদীখননে বাধা সৃষ্টি হওয়া। সাগরের পানির গতি প্রবাহ প্রবেশের পথ খুঁজে না পাওয়া। জোয়ারের পানি সঠিকভাবে ওঠানামা করতে না পারায় পলিজমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদী মরে যাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিতভাবে বাঁধের উপরে  গেট নির্মাণ করা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব মতে, সাতক্ষীরার ২৭টি নদীর শাখা প্রশাখায় প্রবাহিত ছিল ৪২৯টি খাল। দখল, অপরিকল্পিত স্লুইসগেট অবকাঠামো নির্মাণ ও পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাবে বেশির ভাগ খাল এখন অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। অনেক জায়গায় নদী ও খালের বুকে জেগে উঠা চরে মানুষ বসতি শুরু করেছে। ১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশকে এসব খালের উপর নির্মিত ২১৬টি স্লুইস গেট অকেজো হয়ে কালের সাক্ষীতে পরিণত হয়েছে।

জানা গেছে, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি বিভাগের আওতায় ২১৬টি স্লুইসগেট রয়েছে। এরমধ্যে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর অধীনে ১২৩টি স্লুইসগেট রয়েছে। যার ৩৪টি সম্পূর্ণ অকেজো। এছাড়া সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর অধীনে ৯৩টি স্লুইসগেটের মধ্যে ২৮টি সম্পূর্ণ অকেজো পড়েছে। ৫০টির তলদেশ পলি জমে উঁচু হয়ে যাওয়ায় এগুলো পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।

পাউবো-১ এর এক তথ্যে দেখা যায়, ১২৩টি স্লুইসগেটের মধ্যে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সালে নির্মিত ৩৫টি, ১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ সালে নির্মিত ৫টি, ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সালে নির্মিত ৩০টি, ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৬ সালে নির্মিত ৪৮টি এবং ১৯৮৯ থেকে ৯৩ সালে নির্মিত ৫টি। যার বেশির ভাগ স্লুইসগেট এখন অকেজো।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর অধীনে ডিভিশন ১, ৩, ৫ ও ১৫ এর আওতায় সাতক্ষীরা সদর, আশাশুনি, দেবহাটা, কালিগঞ্জ, শ্যামনগ অংশে হাবড়া এবং সদর ও আশাশুনির মরিচ্চাপ, তালায় কপোতাক্ষ ও সালথা নামে ৪টি নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে পড়েছে। পানি নিষ্কাশনের খালগুলো প্রভাবশালীরা দখল করে মাছের ঘের তৈরি করেছে। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে পানি নিষ্কাশনের সব পথ।

জেলে সুনিল সরকার জীবিকার সন্ধানে জাল নৌকা নিয়ে সুন্দরবনের উপকূলে চলে আসেন প্রথমে ১৯৮৮ সালের চিত্র-খোলপেটুয়া নদী তে চুনা মালঞ্চ দিয়ে বর্তমানে দশটি নৌকা মাছ সংগ্রহ করছে মুন্সিগঞ্জ পূর্ব কালিনগর সরদার বড়ি ঘাটে।

আকড়ে ধরে রেখেছেন নিজস্ব সংস্কৃতি ও সুন্দরবনের নিয়ম কানুন মাবনবিবির পূজা  ও সংস্কৃতি গান উপকূলীয় অঞ্চলে প্রকৃতিনির্ভর জেলে পরিবার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সব কিছু হারাতে বসেছে।

জেলে সুনীল সরকার বর্তমানে তার একটা ছেলে একটা মেয়ে নিয়ে অতি কষ্টে জীবন অতিবাহিত করছে। সুন্দরবনের মাছ কাঁকড়া ধরে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করছে বলেও জানা যায়।

বিলাল হোসেন

০১৯১৬৪৯৫১৭০

Join Our Coastal Community

Be part of the solution to climate change. Your voice matters in our mission. Get monthly update from us straight to your mailbox.

By clicking Sign Up you're confirming that you agree with our Terms and Conditions.
Thank you! Your submission has been received!
Oops! Something went wrong while submitting the form.