লবন তাপে পুড়ছে নারী

Published on
May 18, 2025

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী ইউনিয়নের শৈলখালী গ্রামের বাসিন্দা জেসমিন আক্তার (৩২)। সকালের শুরুতেই কলস নিয়ে ছুটতে হয় তাকে। দুই-তিন কিলোমিটার পায়ে হেটে যান খাবার পানি আনতে। সেই পানিতে রান্না ও খাওয়া।

রান্না শেষে ছেলে ও বৃদ্ধ মাকে খাওয়ান। ছেলে চলে যায় স্কুলে। মাকে রেখে জেসমিন বের হয়ে পড়েন কাজের সন্ধানে। জেসমিনের নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই। বছরের সময়ভেদে তাকে বিভিন্ন কাজ বেছে নিতে হয়।

কখনও রাস্তা মেরামত, কখনও দিনমজুর। এ ছাড়া ধান কাটা, মাটি কাটাসহ নদীতে মাছ ধরে বিক্রি; এর সবই করতে হয় তাকে।

গ্রীষ্মে ঘরের বাইরে চুলায় রান্না করেন জেসমিন। এরপর কর্মস্থলে গিয়েও তাকে তীব্র তাপ সহ্য করে কাজ করতে হয়।

জেসমিন বলেন, এখানে সব জায়গায় লবন পানি। খাবার পানি পাওয়া যায় না। দূর থেকে সংগ্রহ করে আনতে হয়। এটি নিয়মিত হয়ে গেছে। প্রতিদিনই পানি আনতে যেতে হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মতো দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে। ঘরের খাবার রান্না থেকে শুরু করে পানির ব্যবস্থা করতে হয় মূলত নারীদের। যে জন্য তাদের রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়।

তবে সম্প্রতি এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাপমাত্রা বৃদ্ধি। যে কারণে এই নারীরা ঘরে ও বাইরে আরো প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছেন। বিশেষ করে, রান্না ও কর্মস্থলে।

জেসমিন গ্রীষ্মের দাবদাহের মধ্যে ঘরের বাইরে থাকা খোলা চুলাতেই রান্নার কাজ করেন। সকালের শুরুতে তখন তার মাথার ওপর থাকে সূর্য। চুলার আগুন ও মাথার ওপরের সূর্যের তাপ সহ্য করেই তাকে রান্না শেষ করতে হয়।

এখানেই শেষ নয়। এরপর বেরিয়ে পড়তে হয় কাজের সন্ধানে। সেখানেও তীব্র তাপদাহ সহ্য করতে হয়।

ছেলের বয়স যখন দুই বছর তখন জেসমিনের স্বামী অন্যত্র বিয়ে করেন। জেসমিনকে চলে আসতে হয় বাবার বাড়িতে। জেসমিনের বাবা মারা গিয়েছিলেন সে ঘটনার আগে। ফলে মা ও ছেলেকে নিয়ে শুরু হয় জেসমিনের সংগ্রাম।

জেসমিন বলেন, বসে থাকলে হয় না। ছেলের পড়াশোনা ও মায়ের ‍ওষুধের টাকাও তাকেই ব্যবস্থা করতে হয়।

ব্যক্তিজীবনের গল্পটা ভিন্ন হলেও উপকূলের অধিকাংশ নারীর জীবন যুদ্ধের গল্প জেসমিনের মতোই। প্রতিনিয়ত তাদের লবণাক্ততা ও তাপপ্রবাহের মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে।

জেসমিন জানান, শীতকালে তীব্র শীতে নদীতে মাছ ধরতে অসুবিধা হয়। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় ভোগেন গ্রীষ্মকালে। নদীর পানি ও টিউবওয়েলের পানি লবনাক্ত হওয়ায় খাবার পানির সংকটে ভুগতে হয়। বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে রেখে তা পান করতে পারলেও গ্রীষ্মের মৌসুমে যখন অনাবৃষ্টি দেখা দেয়, খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। বাধ্য হয়ে ২ থেকে ৩ কিলোমিটার দূর থেকে গিয়ে খাবার পানি সংগ্রহ করে আনতে হয়। পায়ে হেঁটে কলস নিয়ে পানি সংগ্রহ করতে যান তিনি।

স্থানীয়রা বলছেন, শ্যামনগর উপজেলার গ্রামের অধিকাংশ মানুষ পুকুরেই গোসল করেন। গ্রীষ্ম মৌসুমে যখন পুকুরের পানি শুকিয়ে যায় তখন বাধ্য হয়ে নদীর লবনাক্ত পানিতেই গোসল করতে হয়। এতে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগসহ বিভিন্ন চর্ম রোগ দেখা দেয়।

নদী ভাঙন হলে নদীর লোনা পানি ঢুকে পড়ে লোকালয়ের মিঠা পানির পুকুর ও মাছের ঘেরে। ধান ও তরমুজসহ মাঠ ফসলের ব্যাপক হয়। জলবায়ুজনিত এসব সমস্যায় বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয় নারীদের।

কৈখালী ইউনিয়নের সাহেবখালী গ্রামের বাসিন্দা জবেদা খাতুন। স্বামী মারা গেছেন ৭ বছর আগে। কোনো ছেলে সন্তান নেই। তিন মেয়ে রয়েছেন, তারা বিবাহিত। ফলে একাই ছোট একটি খড়ের ছাউনির মাটির ঘরে বাস করেন তিনি।

সংসারের খরচ ও নিজের চিকিৎসা খরচ জোগাতে নদীতে মাছ ধরে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন জবেদা। মাঝেমধ্যে মাছ নিয়ে গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ফেরি করেও বিক্রি করেন। এ ছাড়াও অন্যের বাড়িতে গৃহস্থালীর কাজও করেন তিনি। দিনমজুর ভিত্তিতে বিলে ধানের জমি থেকে ঘাষ বেঁছে ফেলা দেওয়া ও ধান মাড়াইয়ের কাজসহ বিভিন্ন কাজও করেন তিনি।

গ্রীষ্মকালে তীব্র দাবদাহের সময় পুকুর ও খালবিল শুকিয়ে গেলে খাবার পানির সংকট ও গোসলের পানির সংকটে ভোগেন তিনি। বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে গিয়ে শৈলখালী গ্রামের একটি নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয় তাকে। বর্ষাকালে মাটির ঘরের খড়ের ছাউনি ছিদ্র হয়ে পানি ঢুকে যায় ঘরের মধ্যে।

এ ছাড়াও অতিবৃষ্টিতে বাড়ির উঠানে বা খালবিলে পানি জমে যায় তখন তার ব্যবহৃত বস্তা দিয়ে চারপাশ ঘিরে তৈরিকৃত টয়লেটের ভেতরেও পানি চলে যায়। ঘূর্ণিঝড়ে মাঝে মধ্যে টয়লেটের বেড়া ও ছাউনিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড়ে নিজের ঘরের ছাউনিও উড়ে যায়। প্রচন্ড শীতে নদীতে নেমে মাছ ধরতে অসুবিধা হয়। ভালো শীতের পোশাক না থাকায় দিনমজুরের কাজ করতেও অসুবিধা হয়।

জবেদা বলেন, ‘বাঁচতে হলে তো এগুলো করাই লাগবে। কেউ তো আর আমাদের খাওয়াবে না। তাই নিজেদেরই সব করা লাগে।’

দিন দিন তাদের এই ভোগান্তি বাড়ার কথাও জানালেন তিনি। তার মতে, আগে এতটা গরম পড়েনি। এখন নিয়মিত ঝড়-ঝঞ্ঝাট দেখা দেয়। পানির সমস্যাও বাড়ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যেও তাপমাত্রা বাড়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। সংস্থাটির তথ্যমতে, গত ১৪ বছরে খুলনা ও পার্শ্ববর্তী উপকূলীয় অঞ্চলের তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

২০১১ সালে এই অঞ্চলের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ছিল ৩১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ২০২৪ সালে সেই তাপমাত্রা হয় রেকর্ড ৪১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি জলবায়ু পরিবর্তনেরই প্রভাব। এ কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ নানা প্রাকৃতিক প্রভাব পড়ছে।

জলবায়ু নিয়ে কাজ করে শ্যামনগর উপজেলার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সরুপ ইয়ুথ টিম। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা জান্নাতুল নাইম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপপ্রবাহ বাড়ছে। এটির জন্য নারীরা ভুক্তভোগী হচ্ছেন বেশি। তীব্র দাবদাহে এলাকার সব জলাশয় শুকিয়ে যায়। নলকূপের পানিও নোনা।

তিনি বলেন, অত্যধিক তাপপ্রবাহের মধ্যেও তাদের ভারী কাপড় পড়ে থাকতে হয়। তাপপ্রবাহের মধ্যে রান্নাঘরে প্রতিদিনই সময় দিতে হয়। দরিদ্রতার কারণে তাদের রান্নার জন্য উন্নত ব্যবস্থা নেই। পুরনো পদ্ধতির চুলায় তাপ ও ধোঁয়ার মধ্যেই রান্না করতে হয়। তাদের পেশাগত জায়গায়ও ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। লবনাক্ততার কারণেও তারা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছেন। নারীরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

বেশ কয়েক বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরিন। তিনি বলছেন, নারীদের জন্য সমস্যাটা আরো প্রকট একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বাংলাদেশের সমাজে চলমান লিঙ্গ বৈষম্য জলবায়ু পরিবর্তনে নারীদের আরো বেশি ভোগাচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘লবণাক্ত পানিতে নারীদের কাজ করতে হচ্ছে। মাসিকচক্রে গোলমাল দেখা দিচ্ছে ও প্রজনন স্বাস্থ্যেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সুপেয় পানির জন্য তাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। আমাদের দেশে ধরে নেওয়া হয়, রান্না, পানি সংগ্রহ করার মতো কাজগুলো নারীদের। ফলে এই জেন্ডার ডাইমেনশন ওই এলাকায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।’

এই অধ্যাপক বলছেন, দুর্গম এলাকা ও দরিদ্র নারীরা সহজে স্বাস্থ্য সেবা ও প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো পেতে সক্ষম হন না। লবনাক্ততার কারণে তারা শাক-সবজিও চাষ করতে পারেন না। নারীদের কিছু প্রতিবন্ধীকতা স্বাভাবিকভাবেই থাকে। আবার তাদেরকেই দূর থেকে পানি আনতে হয়। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলাটা তাদের করতে হয়। ওয়াটার ডিজিজও তাদের বেশি সাফার করে। সামাজিক স্তরবিন্যাসের কারণেও অনেকে সুপেয় পানি পেতে সমস্যায় পড়েন।

About author

MD Moinur Rahman

Summ: I live in Khulna Bangladesh, and my vision is to empower people in the coastal areas as well as let their stories get known all over Bangladesh.

Learn Climate Journalism

CoastalLab Newsletter

Be part of the solution to climate change, sign-up to CoastalLab Newsletter to get monthly update from us straight to your mailbox.

Get practical guides, handbooks, and resources to strengthen your coastal and climate journalism journey.

Thank you! Your submission has been received!
Oops! Something went wrong while submitting the form.